
নিউজ পয়েন্ট সিলেট
শুক্রবার, ২৭ আগস্ট, ২০২১
কাচের জুতা পায়ে দেওয়ার পর ছাইয়ের বিছানা থেকে রাজপ্রাসাদে পৌঁছেছিল সিন্ডারেলা। গুপী-বাঘার জুতো জোড়ার কথাও সবারই জানা। রূপকথার সেই সব চরিত্রের সঙ্গে ভারতের মণিপুর রাজ্যের মুক্তামণি দেবীর মিল আছে। কারণ মুক্তামণির উত্থানও জুতোর দৌলতে। সেও এক রূপকথা।
তবে এই জুতো সিন্ডারেলার মতো ‘পড়ে পাওয়া’ নয়। রূপকথার গল্পের মতো সাফল্য আসেনি মুক্তামণির। তিনি জুতা বানিয়েছিলেন হাতে বুনে। পরিশ্রম করেই নিজের জায়গা করে নিতে হয়েছে তাকে। যে কারণে বাস্তবের কাছাকাছি থেকেও মুক্তামণির গল্প রূপকথার সিন্ডারেলার চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।
১৭ বছর বয়সে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন সহপাঠীকে। স্থায়ী উপার্জন না থাকায় ধানক্ষেতে দিনমজুরের কাজ শুরু করেন মুক্তামণি।
একসময়ে সন্তানের জন্য জুতা কেনার টাকাও ছিল না। আর এখন বিশ্বমানের জুতা ব্যবসায়ী মুক্তামণি। তার তৈরি জুতা রপ্তানি হয় বিদেশে। অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, মেক্সিকো, দক্ষিণ আফ্রিকা এমনকি ফ্রান্সেও চাহিদা রয়েছে মুক্তামণির জুতার।
মুক্তামণির বাড়ি মণিপুরের কাকচিংয়ে। চার সন্তানের মা। নুন আনতে পান্তা ফুরনো সংসার টানতে উদয়াস্ত খাটতেন এক সময়।
মাঠের কাজ তো ছিলই। সেই কাজ শেষ করার পরও চলত অর্থ উপার্জনের নানা ফিকির। বাড়ি থেকে খাবার বানিয়ে রাস্তায় বিক্রি করতেন রোজ। ফিরে এসে রাত জেগে উল বুনতেন। ছোটখাটো সেসব শিল্পকর্ম বিক্রি করে যদি হাতে অতিরিক্ত কিছু টাকা আসে!
এর পরও অর্থাভাব থাকত। স্কুলে পড়া মেয়েকে এক জোড়া নতুন জুতা কিনে দেওয়ারও সামর্থ্য হয়নি মুক্তামণির। ছেঁড়া জুতা পরেই দিনের পর দিন স্কুলে যেত তার মেয়ে।
জোড়াতালি দেওয়া জুতা। স্বাভাবিকভাবেই ধীরে ধীরে পরার অযোগ্য হয়ে যায়। মুক্তামণির জীবন বড় বাঁক নেয় তারপর।
জুতা ছাড়া স্কুলে যাওয়া যাবে না বলে মেয়ের পুরনো জুতাটিকেই উল দিয়ে বুনে পরার মতো বানিয়ে দিয়েছিলেন মুক্তামণি। সে জুতা দেখে অবশ্য ভয় পেয়েছিল মেয়ে।
উলের বোনা জুতা তো আর স্কুলের পোশাকের অঙ্গ নয়। যদি শিক্ষিকারা কথা শোনান! ভয়ের কারণ সেটাই।
ভয়ে ভয়েই স্কুলে জুতাটি পরে গিয়েছিল মুক্তামণির মেয়ে। জুতা দেখে এগিয়ে আসেন শিক্ষিকাও। তবে বকুনি দেননি। প্রশংসা করেন।
মুক্তামণির মেয়ের কাছে ওই শিক্ষিকা জানতে চেয়েছিলেন, এই জুতা কোথায় পাওয়া যায়। জানলে তিনিও নিজের মেয়ের জন্য এমন জুতা কিনবেন।
প্রশ্ন শুনে অবাক হয়েছিল মুক্তামণির মেয়ে। মাকে এসে ঘটনাটি বলাতে তিনিই উলের জুতা বানিয়ে দেন। সঙ্গে মাথায় আসে নতুন ভাবনাও- উলের জুতা বানিয়েও তো বিক্রি করা যায়। মানুষ পছন্দ করলে বিক্রি হবে। আসবে টাকাও। মুক্তামণির উলের জুতার যাত্রা শুরু তখন থেকেই। এখন যা দুনিয়া ঘুরে ফেলেছে।
মুক্তামণি এখন মণিপুরের বৈগ্রাহিক নাম। সেখানকার এক নম্বর নারী উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আব্দুল কালাম প্রশংসা করেছিলেন মুক্তামণির কাজের। এমনকি তার উত্থানের লড়াইয়েরও।
জাতীয় স্তরে পরিচিতিও পেয়েছেন মুক্তামণি। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের হাত থেকে পুরস্কারও নিয়েছেন। এমএসএমই অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়েছিল তাকে।
২০১৮ সালে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ বদল এনেছেন এমন ১১ জন উদ্যোক্তাকে বেছে নিয়ে পুরস্কৃত করেছিল ন্যাশনাল ইন্সুরেন্স। মুক্তামণি ছিলেন সেই ১১ জনের মধ্যে একজন।
তার তৈরি উলের জুতা নিয়ম করে রপ্তানি হয় বিদেশে। মুক্তা ইন্ডাস্ট্রি এখন বিশ্বমানের শিল্প প্রতিষ্ঠান। তবে জুতার দাম বেশি নয়। ২০০ টাকায় শুরু হয়ে মুক্তামণির জুতার সর্বোচ্চ দাম ৮০০ টাকা।
সাফল্যের স্বাদ পেয়েও মাটিকে ভোলেননি। কারখানায় স্থানীয় মেয়েদের কাজ দেন মুক্তামণি। মেয়েদের উলের জুতা বানানোর পেশাদার প্রশিক্ষণও দেন।