কামরুল ইসলাম জ্যাকব
বুধবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০২১
অন্যের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে নাক গলানোর বিশ্ব রেকর্ড থাকলে, নিশ্চয়ই সেই পুরষ্কার আমরা বাঙালি জাতি পেতাম। আপনি জানেন কী, এই দেশের ৭১ শতাংশ মানুষ বিষন্নতায় ভুগছে। সারাক্ষণ অন্যের বিষয় নিয়ে মাথা ঘামালে বিষন্নতা হবেই…
কোথাকার কোন রবি সেও নাকি কবি? রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাঙালির তামাশা এমনি ছিল। তার লেখা তুলে দিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছিল, শুদ্ধ করে লিখ।
একইভাবে হুমায়ুন আহমেদ কী লেখে এ নিয়ে রোজ কথা বলতাম আমরা বাংলাদেশিরা। বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে এই কালের মাশরাফি-সাকিব আমাদের গীবত বা পরশ্রীকাতরায় কে নেই? শুধু বাংলাদেশ কেন এই পৃথিবীর এমন কোন মানুষ কী আছে যাকে আমরা সমালোচনা করে উড়িয়ে দেই না?
একটু ভেবে দেখেন। শিক্ষা, দীক্ষা, সভ্যতা, সততা, মানবিকতা, সুশাসন সব দিকে পিছিয়ে থাকা এই জাতি কিছু পারি আর না পারি আমরা আসলে আরেকজনের গোষ্ঠী উদ্ধার করতে পারি।
আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, অন্যের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে নাক গলানোর বিশ্ব রেকর্ড থাকলে, নিশ্চয়ই সে পুরষ্কার আমরা বাঙালি জাতি পেতাম। আপনি জানেন কী এই দেশের ৭১ শতাংশ মানুষ বিষন্নতায় ভুগছে। আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, সারাক্ষণ অন্যের বিষয় নিয়ে মাথা ঘামালে বিষন্নতা হবেই।
ব্যাখা করি। ধরেন আপনি কোন অফিসে কাজ করেন। বছরশেষে নিজের পদোন্নতি হলো কী না কিংবা বেতন কতো বাড়লো তার চেয়েও আমাদের বেশি আগ্রহ থাকে আরেক সহকর্মীকে নিয়ে। আমরা আসলে নিজেদের সুখ খুঁজি আরেকজনকে দিয়ে। ফলাফল বিষন্নতা।
একটু ভাবুন। আপনি যে কোন আড্ডা আর আলোচনার বিষয়বস্তু দেখেন। সারাক্ষণ অন্যের গীবত। কোন আড্ডায় আপনি একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে বলুন, মানুষটা সৎ কেউ বিশ্বাস করবে না। কেউ সেটা আরেকজনের কাছে ছড়াবে না। কিন্তু আপনি বলুন পুলিশটা চোর। ঢাকায় তিনটা ফ্ল্যাট। যে তাকে চেনে না সেও বলবে, শালা আসলেই চোর। আমিও জানতাম। সবাই সেটা ভাইরাল করবে।
শুধু ব্যক্তিজীবন নয়। আমাদের রাজনীতি মানে বিরোধী দল কী অপকর্ম করেছে তার কথা। চায়ের আসর থেকে শুরু করে অফিস আদালত রাষ্ট্র সমাজ সর্বত্র গীবত স্বভাবসুলভ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ইসলামের দিকে তাকান। কথায় কথায় আমরা বলি ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ। অথচ মুসলমান হিসেবে গীবত বা পরনিন্দাকে সম্পূর্ণরূপে হারাম ঘোষণা করে তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ইসলামের দৃষ্টিতে গীবত শোনাও অন্যায়। মদপান, চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার ইত্যাদি থেকেও গীতবতে মারাত্মক ও নিকৃষ্টতম বলা হয়েছে। কারণ এসব পাপ তওবার দ্বারা ক্ষমা পাওয়ার উপযুক্ত। কিন্তু গীবতকারীর পাপ শুধু তওবা করলেই তা মাফ হবে না, বরং যার বিরুদ্ধে গীবত করা হয়েছে সে ব্যক্তি যদি মাফ করে তাহলেই আল্লাহর কাছে মাফ পাওয়া যাবে।
অরেকটু সহজ করে বলি। গীবত আরবি শব্দ। এর অর্থ পরনিন্দা। ইসলামের পরিভাষায় কারও অনুপস্থিতিতে তার কোনো দোষ-ত্রুটি অন্যের কাছে আলোচনা করাই গীবত। আমাদের নবী মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক সাহাবীর প্রশ্নের জবাবে বলেন- ‘গীবত হচ্ছে যা শুনলে তোমার ভাইয়ের খারাপ লাগবে, তা নিয়ে আলোচনা করার নামই গীবত।’
ওই সাহাবি আবার জিজ্ঞেস করেন, আমি যা বলছি তা যদি ওই ব্যক্তির মধ্যে বিদ্যমান থাকে তবু কি তা গীবত হবে? তখন মহানবী (সা.) প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘যদি তার মধ্যে ওই দোষগুলো থাকে তাহলেই তো গীবত হবে আর তা না থাকলে সেটা হবে তোহমত যার অর্থ অপবাদ।’
পবিত্র কোরআনে কারিম ও হাদিস শরিফে গীবত সম্পর্কে কঠোর ভাষায় হুশিয়ার করে দেওয়া হয়েছে বারবার। সূরা হুজরাতের ১২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অনুমান থেকে দূরে থাকো। কেননা অনুমান কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাপের কাজ। তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না এবং একে অপরের পশ্চাতে গীবত করো না।’
নবী করীম (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউই কারও গীবত করবে না। গীবত করলে তোমরা ধ্বংস হবে।’ মহানবী আরও বলেন, ‘তোমরা গীবত থেকে বেঁচে থাকো। কারণ তাতে তিনটি ক্ষতি রয়েছে-১. গীবতকারীর দোয়া কবুল হয় না, ২. গীবতকারীর কোনো নেক আমল কবুল হয় না ও ৩. আমলনামায় তার পাপ বৃদ্ধি হতে থাকে।
কোরআন ও হাদিসে গীবতকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যারা গীবত করবে এরা ইহকালে যদিও ভালো ভালো নেক আমল করে, রোজা রাখে বা অন্যান্য ইবাদত করলেও এদের পুলসিরাত অতিক্রম করতে দেওয়া হবে না। বরং তাদেরও বলা হবে- তোমরা গীবতের কাফ্ফারা না দেওয়া পর্যন্ত সামনে এগুতে পারবে না।’ ‘এর মানে হলো পুলসিরাত অতিক্রম না করে কারও পক্ষেই জান্নাতে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই বোঝা গেল, গীবতকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।
বহুবার বলেছি এই গীবত আর পরশ্রীকতারতটা যদি বাদ দিতে পারি জীনবটা সুন্দর হয়ে যাবে। সারাক্ষণ অন্যের দিকে আঙুল না তুলে চলুন আয়নার সামনে দাঁড়াই। নিজেকে বিবেচনা করি। দেখবেন লজ্জায় কুকঁড়ে যাবেন যদি মানুষ হন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে গীবত আর পরশ্রীকাতরতা থেকে দূরে রাখি। চলুন আজ থেকে শুরু করি।