
নিউজ পয়েন্ট সিলেট
বৃহস্পতিবার, ২২ এপ্রিল, ২০২১
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে কালের সাক্ষী হয়ে আছে প্রায় আড়াইশ’ বছর আগের তৈরি একটি ছোট দুর্গ। উপজেলার ইসলামপুর পশ্চিম ইউনিয়নের পাড়ুয়া গ্রামে সবুজ-শ্যামল পরিবেশে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুর্গটি। ইতিহাস থেকে জানা গেছে, ব্রিটিশ শাসক রবার্ট লিন্ডসে ১৭৭৮ সালে সিলেটের কালেক্টরের দায়িত্বে থাকাকালে এই দুর্গটি নির্মাণ করা হয়েছিল। দুর্গটির নাম দেয়া হয়েছিল ‘পান্ডুয়া দুর্গ’। লিন্ডসের উল্লেখিত ‘পান্ডুয়া’ বর্তমানে কোম্পানীগঞ্জের একটি গ্রাম। ‘পাড়ুয়া’ নামটি ‘পান্ডুয়া’ এর রূপান্তর। অবহেলা-অযত্নে পড়ে থাকায় প্রাচীন এই নিদর্শনটি তার আদিরূপ হারালেও দুর্গটিকে ঘিরে দর্শনার্থীদের আগ্রহের কমতি নেই। স্থানীয়দের দাবি, প্রাচীন এই নিদর্শনটি সংরক্ষণ করা গেলে এটি পর্যটকদের অনেকটাই আকৃষ্ট করবে।
ঐতিহাসিকদের মতে, উপনিবেশিক আমলে সিলেট ছিল চুনাপাথর সরবরাহের একটি বিরাট কেন্দ্র। আসলে চুনাপাথর সিলেটে পাওয়া যেত না। এগুলো আসত আসাম, কাছাড় খাসিয়া ও জৈন্তা অঞ্চল থেকে। সে সময় ওইসব অঞ্চল সিলেটের নামে পরিচিত হওয়ার কারণে সিলেট হয়ে পড়ে চুনাপাথর সরবরাহ আর ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু। ১৭৭৮ সালে সিলেটের ডেপুটি কালেক্টরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন রবার্ট লিন্ডসে। তখন আসামের পান্ডুয়া অঞ্চলটি ছিল ছোট ছোট খাসিয়া রাজাদের অধীন। চুনার পাহাড়টি ছিল এমনি একজন রাজার রাজ্যে অবস্থিত। দূর-দূরান্ত এলাকা থেকে চুনাপাথরের ব্যবসার জন্য আসা ব্যবসায়ীদের উপর খাসিয়ারা তখন আক্রমণ চালাত। খাসিয়াদের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে অনেক বণিক তখন রবার্ট লিন্ডসেকে অনুরোধ করেছিলেন- তাদের যেন একটি ছোট ইটের দুর্গ তৈরি করে দেন। তাদের অনুরোধেই রবার্ট লিন্ডসে পাড়ুয়ায় ভ্রমণ করেন এবং ওই দুর্গটি নির্মাণ করেছিলেন।
সিলেটে ১২ বছর কালেক্টর হিসাবে দায়িত্ব পালন করা বরার্ট লিন্ডসের ১৮৪০ সালে একটি আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়। বইটির বাংলা অনুবাদ করেছেন কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক সিলেটের ডাক-এর নির্বাহী সম্পাদক আবদুল হামিদ মানিক। বাংলায় বইটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘সিলেটে আমার ১২ বছর’।
বইয়ে সিলেটের ভৌগলিক অবস্থার পাশাপাশি কোম্পানীগঞ্জের পাড়ুয়া এলাকায় নৈসর্গিক সৌন্দর্য চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে। বইয়ের ৮৮ পৃষ্ঠায় পরিশিষ্ট ৩ এ পাড়ুয়া সম্পর্কে লেখক যেসব মন্তব্য করেছেন তা নিম্নরূপ- পাড়ুয়ার দৃশ্য দেখে লিন্ডসে মুগ্ধ হন। তাঁর ভাষার ‘পাড়ুয়া পৃথিবীর বৃহত্তম উন্মুক্ত রঙ্গমঞ্চ। পাড়ুয়াতে লিন্ডসে একটি কুঠিরও নির্মাণ করেছিলেন। মনোরম পরিবেশে নির্মিত কুঠিরটি আসলে ছিল ছোট খাটো একটি দুর্গ। তাই শুধু নিসর্গের সৌন্দর্যের জন্য নয় অন্য কারণেও পাড়ুয়ার গুরুত্ব রয়েছে । খাসিয়া জৈন্তা পাহাড় সংলগ্ন সমগ্র অঞ্চলই প্রকৃতি প্রেমিকদের মুগ্ধ করে।
পাহাড়টি মনে হয় যেন হঠাৎ করে সমতল জলাভূমি থেকে ওপরে উঠে গেছে। পর্বতমালা বন-বনানী মনোহর পত্রপল্লবে শোভিত। চারদিকে গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের নানা প্রজাতির ফলদ বৃক্ষের সারি। …নিসর্গের এত মনোরম রূপ আমি কোথাও দেখিনি।’
এদিকে, ইংরেজ শাসকদের তৈরি ‘পান্ডুয়া দুর্গ’ এতদিন লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল।
কোম্পানীগঞ্জের প্রাচীন এই নিদর্শনটির ছবি তুলে অনেকে ফেইসবুক-ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন সাইটে আপলোড করছেন। তাদেরই একজন স্থানীয় ট্যুরিস্ট ফটোগ্রাফার ইমরান আহমদ। তিনি জানান, শখের বশে তিনি ফটোগ্রাফি করেন। পাড়ুয়া দুর্গ কোম্পানীগঞ্জের একটি প্রাচীন নিদর্শন। ঠিকমত প্রচার করা গেলে প্রাচীন এই নিদর্শনকে ঘিরে দর্শনার্থীদের আগ্রহ বাড়বে। তাই ছবি তুলে গুগল এবং উইকিপিডিয়ায় আপলোড করেছি।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ শামীম আহমদ জানান, ব্রিটিশ আমলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় যত স্থাপনা ছিল, পাড়ুয়া দুর্গ তার একটি। এক সময়ের দৃষ্টিনন্দন এই দুর্গটি এখন বিলুপ্তির পথে। ইট-চুন-সুড়কি দিয়ে নির্মিত স্থাপনাটির অনেকাংশের অস্তিত্ব নেই। প্রাচীন এই দুর্গটির সংস্কার তাই এখন সময়ের দাবি।
কোম্পানীগঞ্জ সমিতি- সিলেটের সাধারণ সম্পাদক মোঃ রফিকুল হক বলেন, পাড়ুয়া দুর্গ ছাড়াও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় এ রকম আরও প্রাচীন নিদর্শন রয়েছে, যেগুলো সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। দেশীয় ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার স্বার্থে দুর্গটি সংস্কার করে সংরক্ষণ করা উচিত। তবেই কালের সাক্ষী হয়ে রবে এই প্রাচীন স্থাপনাটি।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সুমন আচার্য বলেন, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। পাড়ুয়া দুর্গ এ অঞ্চলের একটি প্রাচীন নির্দশন। এটিকে সংরক্ষণ করা উচিত। কেননা, এসব নিদর্শন আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে লালন করে।